Poem

শনিবার, ৩১শে অক্টোবর, ১৯৯২
মাঠে মাঠে রবিশস্য বোনার কাজ চলছে সারাদিন
নামলো সন্ধ্যা
পাতলা অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়েছে দূরের পাহাড়
পাখিরা ফিরছে, বাতাস বইছে বিপরীত দিকে
এখন ঘরে ফেরার সময়
যাদের ঘর নেই তারাও ফেরে
ওদের ক্লান্ত পা, গলায় গুনগুনে স্বর, মাথায় জড়ানো গামছা
পাম্প হাউজে এসে টিউবওয়েলের জলে ধুয়ে নিল হাত মুখ
আঃ কী নির্মল, ঠাণ্ডা জল, ধরিত্রীর স্নেহ
জুড়িয়ে দেয় শরীর
একটা বিড়ির সুখটান, তারপর উনুন ধরাবার পালা
কয়েকজন রুটি পাকাবে, দু-একজন রাঁধবে অড়হড় ডাল,
ভেণ্ডির সবজি
আর একজন না-সাধা গলায় গাইবে গান :
“হোইহি সোই জো রাম রচি রাখা
কো করি তর্ক বঢ়াবৈ সাখা…”
যে গায় এবং যারা শোনে, তাদের এক ঝলক মনে পড়ে
সুদূর পূর্ণিয়া জেলার গ্রামের বাড়ি, ঘরওয়ালী ও
বাল-বাচ্চার মুখ
ওরা এখন পঞ্জাবের ভাড়াটে চাষী
অন্যের জমিতে এক মৌসুমের ঠিকা
দিনভর সূর্য পোড়ায় মাথা, নিঙড়ে নেয় মজ্জা
সন্ধেবেলা পেটের মধ্যেই জ্বলে উনুন, চোখ দিয়ে খাওয়া
ডাল-রুটি
তারপর খোলা আকাশের নীচে খাটিয়ায় চিৎপটাং
বিড়িতে টান দিতে দিতে ঘুমোবার আগেই দেখা দু-একটা স্বপ্ন
জীবন এর চেয়ে বেশি কিছু দাবি করেনি…
রুটি সেঁকা হয়ে গেছে, ফুটন্ত ডালে যেই দেওয়া হলো লঙ্কা
ফোড়ন
তখনই এলো দুই আগন্তুক, হাতে সাব মেশিনগান
ছদ্মবেশ ধরার কোনো চেষ্টাই নেই, চোখে নেই দ্বিধা
কেউ কারুকে চেনে না, এদের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও শত্রুতা
ছিল না
সেই দুই কাল্পনিক দেশপ্রেমিক ছেলেখেলার মতন চালিয়ে দিল
গুলি
উল্টে গেল ডালের গামলা, ছড়িয়ে গেল বাসনা-নিশ্বাস লাগা
রুটি রাশি
জানলোই না কেন তারা মরছে, বুঝলোই না মৃত্যুর রূপ কেমন
পঁচিশজন সেখানেই শেষ, বাকিদের ছিন্নভিন্ন হাত-পা
এবার ছুটে আসবে শকুন-শেয়ালের পাল….

দুই আততায়ী অস্ত্রের নলে ফুঁ দিয়ে ধীর পায়ে উঠে গেল
জিপে
গ্রামের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা
কোনো বাড়িতে শ্বেত শ্মশ্রু এক বৃদ্ধ পাঠ করছেন গ্রন্থসাহেব :
“সাধো মন কা মান তিআগউ
কাম ক্রোধু সংগতি দুরজন কী তাতে অহিনিস ভাগউ…”
জমির ফসলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুবাতাস
এই মাত্র চাঁদ উঠে ছড়িয়ে দিল জ্যোৎস্না

তুলসীদাসের দোঁহায় রামের গুণগান করছিল যে শ্রমিকটি
তার কণ্ঠ এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেছে
রামচন্দ্রজী, তোমার ভক্তদের তুমি রক্ষা করলে না?
যারা অযযাধ্যায় মসজিদ ভেঙে রামমন্দির বানাবার জন্য উন্মত্ত
তারাও কেউ এইসব মানুষদের বাঁচাতে আসবে না কোনোদিন
গুরু নানক, আপনি দেখলেন আপনার রক্তপিপাসু ভক্তদের
এই লীলা
গুরুজী, গুরুজী, আপনার নামে ওরা জয়ধ্বনি দিয়ে গেল?

জম্মু থেকে এই শনিবারই একটা বাস ছাড়লো
সকাল সাড়ে আটটায়, যাবে কাঠুয়া
ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে, শোনা যাচ্ছে মিশ্র কলস্বর
মায়েরা সামলাচ্ছে বাচ্চাদের, এক কিশোরীর হাতে
জিলিপির ঠোঙা
জানলায় থুতনি-রাখা তার ছোট ভাইটির চোখে বিশ্বজোড়া
বিস্ময়
আকাশ আজ প্রসন্ন নীল, উপত্যকায় উড়ছে কুসুম রেণু
যাত্রীরা কেউ ফিরছে গ্রামের বাড়িতে, একজন যাচ্ছে বিয়ে
করতে
আপন মনে বাসটা যাচ্ছে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
একটা বাঁক পেরুবার মুখেই বজ্রপাতের মতন বিস্ফোরণ
উড়ে গেল জিলিপির ঠোঙা ধরা কিশোরীর হাত
বালকটির ছিড়ে যাওয়া মুণ্ডুতে চোখ দুটো নেই
সন্তানকে বুকে জড়ানো জননী আর্ত চিৎকারেরও সময়
পেলেন না
কালো বোরখা পরা আর একটি রমণীর নিস্পন্দ শরীর
এই প্রথম উন্মুক্ত হলো প্রকাশ্যে
বলশালী পুরুষদেরও শেষ হয়ে গেল সব নিশ্বাস
মোট সতেরো জন, বাকিরাও মৃত্যুর অতি কাছাকাছি দগ্ধ
কেউ একজন যেন কৌতুক করে রেখে গিয়েছিল একটা
পেনসিল বোমা
সেই হত্যাকারী আল্লার সেবক, ধর্মের ঝাণ্ডা তোলার জন্য
রক্তনদী বইয়ে দিতেও দ্বিধা নেই
যারা প্রাণ দিল তারাও আল্লার সন্ততি
পাঁচ ওয়ক্ত নিত্য নামাজ পড়া দুই প্রৌঢ়ও নিস্তার পায়নি
এক মৌলবী সাহেবের ডান পা অদৃশ্য হয়ে গেছে
হায় আল্লা, হে খোদাতালা, হে খোদাতালা…

মনরোভিয়া, ডেট লাইন একত্রিশে অক্টোবর
কোথায় গেল সেই পাঁচজন আমেরিকান নান?
আজীবন ব্রতচারিণী, তারা শরীর-মন নিবেদন করেছিল
যীশুকে
আর্তের সেবায় গিয়েছিল দেশ ছেড়ে অমন সুদূরে
কোথায় তারা? না, হারিয়ে যায়নি, পাওয়া গেছে পাঁচটি
শরীর
লাইবেরিয়ায় যুযুধান দু পক্ষের গোলাগুলির মাঝখানে পড়ে
ভূলুণ্ঠিত, বেআব্রু রক্ত-কাদায় মাখামাখি
পরম করুণাময় যীশু কি সেই সময় চোখ বুজে ছিলেন?

বোসনিয়া-সারবিয়াতে শুরু হচ্ছে গ্যাস যুদ্ধ
এতকালের প্রতিবেশী, শুধু ধর্মভেদের জন্য এত ঘৃণা?
পশুরাও তো এমন ধর্মে বিশ্বাস করে না
মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের পুড়িয়ে মারছে যে বর্ণগর্বী হিন্দুরা
তারাই বাড়িতে বসে শ্লোক আওড়ায়, সব মানুষেরই মধ্যে।
রয়েছেন নারায়ণ!

অন্য কবিতা লিখতে শুরু করেছিলাম, কলম সরছে না আমার
না, কবিতা আসছে না, ইচ্ছে করছে না ছন্দ মেলাতে
খবরের কাগজে, বেতারে, দূরদর্শনে শুধু মৃত্যুর নির্লিপ্ত ধ্বনি
অসহায় বিরক্তিতে ছটফট করছে আমার সমস্ত শরীর
ধর্মশাস্ত্রগুলির মহান বাণী টুকরো টুকরো মনে পড়ে, তাতে
আরও কষ্ট হয়
‘হায় ধর্ম, এ কী সুকঠোর দণ্ড তব?’
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ি, কয়েক পা গিয়েই মনে হয়
কোথায় যাচ্ছি?
কেন উঠলাম, কেনই বা ফিরে গিয়ে বসবো টেবিলে
কবিতা হবে না, তবু লিখে যাচ্ছি এই পঙক্তিগুলি।
না, ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকদের জন্য নয়, উন্মাদ জল্লাদদের
জন্যও নয়
শুধু আগামী শতাব্দীর দিকে ছুঁড়ে দেওয়া এই সামান্য
দীর্ঘশ্বাস
মানুষকে ভালোবাসা ছাড়া মানুষের আর কোনো ধর্মই থাকবে
না
তখন, তাই না?

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 354

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts