Poem

রবীন্দ্রনাথের তেইশ বছরের শোক

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

স্পষ্ট দেখা যায় সেই দীর্ঘকায় উজ্জ্বল যুবাকে
ঝকঝকে চোখের রঙ– যাকে দেখে দেবমূর্তি মনে হয়েছিল
নবীন সেনের। পশ্চিমের বারান্দায় স্পষ্ট দেখা যায়
স্তব্ধ তেইশ বছরের সুকুমার ভঙ্গিটির ছবি।
সদর, প্রাঙ্গণ কিংবা সামনের পথের দৃশ্য, মানুষ—
জীবন স্মৃতির কটি পৃষ্ঠা ছিঁড়ে, হে পাঠক, কল্পনার সঙ্গে জুড়ে নিন।

—আমার চোখের জল শিউলি ফুলের মতো ঝরে গেছে আজ ভোরবেলা
কৈশোরে একটি মালা তুমি দিয়েছিলে, তার ফুলগুলি আজ
তোমাকে দিলাম, শুভ্র, চোখের জলের মতো পবিত্র, অম্লান।
কাল সারারাত ভরে রাশি রাশি জোনাকির উৎসব দেখেছি
পথভ্রষ্ট এক বনে,— মনে হল যেন আমি নীল অন্ধকারে
একটি নীলরঙা পাখি খুঁজতে বেরিয়েছি, যে আমার নাম ধরে
একদিন ঘুম ভাঙবার আগে ডেকে উঠেছিল। হে সখি, বিচ্ছেদ,
বলে দাও কার নাম ভালবাসা, মনে পড়ে একটি পতঙ্গের
ডানা ছিঁড়ে পুকুরের জলে ভাসিয়ে ছিলাম, একদিন নিতান্ত শৈশবে,
বহুদিন পর এক সন্ধেবেলা সেই কথা মনে ভেবে সহসা দুঃখের
প্লাবনে ড়ুবেছি আমি। কে সেই দুঃখের দূতী। তুমি নও, তুমি, ভালবাসা?
পদ্মায় অনেক ছবি দেখেছি, প্রবাসে নীলিমায়
সুন্দরের স্তব্ধ গান, একদিন কোন মন্ত্রবলে
বৃক্ষের ভাষায় আমি বৃক্ষদের সাথে কথা বলতে শিখলাম।
কে শেখাল, ভালবাসা, তুমি ভালবাসা?
আমার চেয়েও তুমি মৃত্যুকে অধিক ভালবেসে কুল ছেড়ে
দেশান্তরে, কালান্তরে চলে গেলে, অথবা নতুন খেলা ভেবে
নিজের হৃদয় জ্বেলে, চন্দন কাষ্ঠের মতো শরীর পুড়িয়ে
মায়াবি দুঃখের সাজে আমাকে সাজালে, সর্ব অঙ্গে, চোখে,
মুখে হাতের নখের কোণে, ভুরুতে, কপালে ঠিক জোনাকির মতো
শীতল আগুন এঁকে দিলে।
এখন আমাকে ঘিরে কে রয়েছে, তুমি নও, মনে হয় অন্য একজন
আমি তার স্পর্শ পাই, আমি তার স্বরূপ জানি না।

—আমি শোক, চিনতে পারোনি, আমি যৌবনের প্রথম প্রহরী,
তোমার হৃদয় আমি মুচড়ে ভেঙে টেনে আনব নির্বাসিত দ্বিতীয় যুবাকে
তোমার অযুত মূর্তি চতুর্দিকে, চেয়ে দেখ, উদ্ভাসিত চোখে
মহর্ষি আকাশ তাঁর দক্ষিণ হস্তের বরাভয়
তোমার সম্মুখ দিকে রেখেছেন; দেখ এই বাতাসের স্রোত
কত প্রিয় শব্দ কত প্রিয় গন্ধ নিয়ে যায়, কুহকী সময়
কালো ওড়না ঢাকা দেয় চকিতে প্রেমের শুভ্র মুখে।
আমি শোক, ব্যাধের শবের মতো শোক—
আত্মশুদ্ধ, মহৎ দস্যুর মতো তোমাকেও পোড়াব তীব্র দাহে,
যেন সেই যন্ত্রণার স্রোত, একদিন নানা বর্ণে উৎসারিত হয়, যেন
প্রতিদিন ভালবাসা এবং আমার প্রতি প্রতিশোধ নিতে
তুমি সব ভুলে থাক, সুখ, শান্তি, সচ্ছলতা তৃপ্তির আসব।

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 132

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts