Poem

শহরের একটি দৃশ্য

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

প্রেসার কুকারে সিটি বেজে উঠলো যেই
সঙ্গে সঙ্গে এলো টেলিগ্রাম
বছর দেড়েক ধরে যে ভুগছিল স্যানাটোরিয়ামে
সে আজ সকালে চলে গেছে
বাড়িতে শোকের কালো ছায়া ঠিক নেমে না এলেও
এ মুহূর্ত থেকে কালাশৌচ
প্রেসার কুকার নামলো, দমকা সুগন্ধ, তার ওপরে ছড়ালো
দীর্ঘশ্বাস

কলতলায় হারানের মা তখন বাসন মাজছিল
যার হাজা ধরা হতে সব সময়ে জ্বালা আর জ্বালা
ভাগ্যটা খুললো তারই
সবটা মাংসই ঢেলে অ্যালুমিনিয়াম ডেকচিতে
দেওয়া হলো তাকে উপহার
তবু তার মুখটা গুমোট, যে রকম রোজই থাকে
তার কোনো মতামত নেই।
তখন হাওয়ায় উড়ছে। রাধাকুড়া, জারুলের রঙিন পাপড়ি
কপিং পেন্সিলে আঁকা মেঘের গা ঘেঁষে যায়
একসার হাঁস।

ডেকচিটা হাতে নিয়ে হারানের মা রাস্তায়
বেরিয়ে এসেছে
তাকে আরও এক বাড়ির কাজ সারতে হবে
তার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় দুই
যুবক-যুবতী
তাদের নিবিড় হাস্যময়তার মধ্যে আছে
কিন্নরলোকের দৃশ্য
পাশে পার্ক, সেখানে আনন্দে খেলে ঝাঁকঝাঁক দেবশিশু
হাতে হাতে আইসক্রিম, পায়ের তলায় ভাঙে
বাদামের খোসা
ঠিক এই সময়েই ঈথারে হুড়াচ্ছে এক কোকিল কাষ্ঠীর গান
বেদনা-মধুর—

অপর বাড়ির কাজ সারতে লাগলো দেড় ঘণ্টা
ডেকচিটা রাখা রইলো সিঁড়ির তলায়
সেখানে ঘুরঘুর করে ফুটফুটে তিনটে বেড়াল
এ বাড়িতে শিশু নেই, বেড়ালেরা এতই আদুরে
সব সময় খাবারে অরুচি, তারা কিছুই ছোঁয় না
শুধু গন্ধ শোঁকে
মনিবানী দয়াবতী, সন্ধেবোলা পিয়ানো বাজান
এ বাড়িতে ঝি-চাকরও চা খায় দু’বার।

বড় রাস্তা পার হতে একবার হারানের মাকে
যে-গাড়িটা দিলে-দিতে-পারতে চাপা, তার গাঢ়
নীল রং, ঝকঝকে সুন্দর
ভিতরে কুকুর আর প্রভু—সকলি বিদেশী।
সুললিত ঘণ্টা নেড়ে দমকল ছুটে যায়
অনির্দিষ্ট দূরের জগতে
নতুন বাড়ির গন্ধ, বারান্দায় সারি সারি টব
বিবাহ বাসর থেকে ভেসে আসে বিখ্যাত শানাই

রেল-লাইনের পাশে বস্তি, তার মুখটায় জমে আছে
পুরোনো কাদা ও জল, ইট ফেলে পথ
খড়-গোর্বরের গন্ধ, লন্ঠনের বুক চাপা আলো
অসভ্য মেয়েলি হাসি, এবং ঝগড়ার ঐক্যতান।
হারান হারিয়ে গেছে বহুদিন, নামটাই আছে।
তাছাড়া রয়েছে বেঁচে আরও পাঁচটি এবং বৃদ্ধটি
হঠাৎ বাতাস এসে ধুয়ে গেল আধো অন্ধকার ঘরটাকে
সকলে চেঁচিয়ে উঠলো, কি, কি, কি, কি, কি, কি?
বেশি হুড়োহুড়ি করে দু’জনে আছাড় খায়
তিনজন কাঁদে
সবচে ছোটটি ন্যাংটো, বেশি লোভী, ঢাকা খুলে
ভেতরে হাতটা ডোবাতেই
বুড়ো ধরে তার কান, চুল টানে
অন্যান্য ভায়েরা
যে এনেছে, সে শুধুই চেয়ে দেখে, ক্লান্ত পক্ষিমাতা।

রেশনের সবটুকু আটা মেখে রুটি গড়া হলো
তোলা উনুনের আচে ছ জোড়া চোখের দ্যুতি
অপেক্ষা মানে ন
এ সময় জ্যোৎসা ভেঙেছে বনে, নগরে নিওন
ছবির উৎসব আছে কোনোখানে
কোথাও বা অন্সরীরা তুলেছে রঙের তীব্র ঝড়
আছে মৃত্যু, আছে দুঃখ, আছে শান্তি,
অনন্তের দীর্ঘ জেগে থাকা
এরই মধ্যে একবার দাঁড়াও সুন্দর,
এই অন্ধকার ঘরে ক্ষণকাল থেমে যাও
তোমার অনেক ছদ্মবেশ, অনেক ব্যস্ততা
একবার দেখে যাও তবু
সর্বাঙ্গ সমেত দুটি মুর্গী, চুরি নয়,
প্রকৃত মশলায় রান্না
তার সামনে মেলে থাকা চকচকে উৎসুক কটি চোখ
ক্ষুধার্তমধুর হাসি
জীবনে প্রথমে কিংবা শেষবার, তবু এই মুহূর্তটি
তোমাকে চেয়েছে কাছাকাছি
অন্তত ন্যাংটো ও লোভী শিশুটির কাঁধে হাত
রাখে একবার।

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 170

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts