Poem

ভাবীকথকের প্রতি

শামসুর রাহমান

তুমিতো এসেই গ্যাছো। তোমাকে দেখেছি শহরের
সবচেয়ে দীন চা-খানায়,
বাস টার্মিনালে, দগ্ধ ঘাসময় মাঠের কিনারে
একা লোকচক্ষুর আড়ালে,
প্রধান সড়কে আর গোধূলিতে পার্কের বেঞ্চিতে,
সন্ধ্যায় ওভারব্রিজে, কখনো চড়কে,
কখনো বা মহরমী শোকার্ত মিছিলে;
দেখেছি ঝিলের ধারে, জন্মান্ধ ডোবার আশেপাশে।

তোমার পরনে নেই জেল্লাদার পোশাক-আশাক,
যা দেখে ঝলসে যাবে চোখ; কত লোক
আসে যায় সর্বদা তোমার পাশ ঘেঁষে। মনে হয়,
করে না তোমাকে লক্ষ কেউ। বেলাশেষে ক্ষীণ আলোয় ফিরতি
মানুষের ঢেউ দোলে, উদাসীন তুমি
তাকাও নিস্পৃহ চোখে চাদ্দিকে এবং স্মিত ঠোঁটে
আওড়াও মনে মনে, কোথায় কে শিশু চোখ খোলে,
কোথায় নিমেষে কার চোখ বুজে যায়,
দিন যায়, দিন যায়;
নও তুমি দীর্ঘকায়, খর্বকায়ও নও। ভিড়ে মিশে গেলে তুমি
সহজে সনাক্ত করা দায়। অথচ কোথায় যেন
কী একটা আছে, বোঝা যায় চোখ পড়লেই,
তোমার ভেতরে।
তোমার দু’চোখ নয় যেমন তেমন। চক্ষুদ্বয়ে
করুণার জ্যোতি খুঁজি; যারা দিব্যোন্মাদ, বুঝি তারা
এমন চোখেরই অধিকারী।
কী বলবে তুমি এই হৈ হুল্লোড়ে? শুনছো নাকাড়া
নাকাড়া বাজছে অবিরাম দশদিকে?
নরনারী উচ্ছল সবাই,
যেন পানপাত্র থেকে ভরা মাইফেলে
উপচে পড়ছে ফেনা অবিরত। কিন্তু প্রত্যেকেই
অস্তিত্বে বেড়াচ্ছে বয়ে ঘুণপোকা; ভব্যতাসম্মত

আচরণে ওরা নড়ে চড়ে ক্ষণে ক্ষণে
পুতুলনাচের মতো। কখনো অভিন্ন ছাঁচে হাসে,
কাঁদে সিনেমার সীটে বসে, ভিটেমাটি আগলায়,
মেতে থাকে শত বছরের আয়োজনে,
গলায় তাবিজ তাগা পরে
কাটায় জীবন।

যখন বলবে তুমি গাঢ় কণ্ঠস্বরে
‘অকস্মাৎ দীর্ণ হবে নিথর মৃত্তিকা,
প্রবল ফুৎকারে ধসে যাবে লক্ষ লক্ষ অট্রালিকা,
কংকাল জীবিতদের কবরে শুইয়ে দেবে খুব
তাড়াহুড়ো করে,
যখন বলবে তুমি
অসংখ্য কবর থেকে মৃতদের উত্থানের কথা,
তেজস্ক্রিয় ভস্মে সমাহিত সব নগরীর কথা,
মানব জাতির দ্রুত পতনের কথা,
রক্ত-হিম-করা
সর্বশেষ সংঘর্ষের কথা,
বেজন্মা, বেনিয়া সভ্যতার নিশ্চিহ্ন হবার কথা,
তখন সে উচ্চারণ কেউ কেউ শুনবে দাঁড়িয়ে
রুটিমাখনের দোকানের ভিড়ে, কেউ
আনকোরা দামি শাড়ি পরখ করার কালে আর
কেউবা আইসক্রীম খেতে খেতে, কেউ সিনেমার
টিকিট কেনার কালে,
কেউবা গণিকালয়ে ঢোকার সময়।

তোমার কম্পিত উচ্চারণে
বস্তুত নগরবাসী দেবে না আমল।
আবছা মনস্কতায় শুনবে, যেমন
শোনে ক্যানভাসারের গৎ-বাঁধা কথা।
যদি দিতে চাও তুমি সত্যতার বিশুদ্ধ প্রমাণ,
তবে সুনিশ্চিত
তোমাকে যেতেই হবে দাউ দাউ
আগুনের মধ্য দিয়ে আর
অলৌকিক নগ্ন পায়ে হেঁটে সাবলীল
পাড়ি দিতে হবে খর নদী।

Author Bio

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯ - ১৭ আগস্ট ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলাদেশের প্রধান কবি হিসেবে মর্যাদালাভ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ, তথা

More

This post views is 111

Post Topics

Total Posts

2547 Published Posts