Poem

AT APOLLINAIRES GRAVE (আপলিনেয়ারের সমাধিতে ॥ অ্যালেন গীন্‌স্‌বার্গ)

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আমি পের লাসেজে আপলিনেয়ারের সমাধি দেখতে গিয়েছিলাম
সেদিনই বড় বড় রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে ইউ এস প্রেসিডেন্ট এসেছিল
সুতরাং নীল ওর্লির বিমান বন্দরে প্যারিসের উপরের বাতাসে বসন্তের
পরিচ্ছন্নতা থাক্‌
আইসেনহাওয়ার আমেরিকার কবরখানা থেকে উড়ে আসছে
এবং পের লাসেজের কবরখানায় মায়াময় কুয়াশা গাঁজার ধোঁয়ার মত
ঘন
পীটার ওরলভস্কি এবং আমি পের লাসেজে নরম ভাবে হেঁটেছিলাম
আমরা দুজনেই একদিন মরবো জানলাম
সুতরাং শহরের মতো ক্ষুদ্র সংস্করণ অসীমে পরস্পর দুজনের ক্ষণিক হাত
নরম ভাবে ধরেছিলাম
পথগুলি, পথের বিজ্ঞাপন, পাহাড় টিলা এবং প্রত্যেক লোকের বাড়িতে
লেখা নাম
শুন্যতার মধ্যে একজন উল্লেখযোগ্য ফরাসির হারানো ঠিকানা খুঁজছিলাম
তাঁর অসহায় স্মৃতিস্তম্ভে আমাদের প্রণামের পাপ জানাতে
এবং তাঁর স্তব্ধ সমাধি ফলকে আমার সাময়িক আমেরিকান গর্জন
শুইয়ে রাখতে
তাঁর পড়ার জন্য লাইনগুলির মধ্যে কবির এক্সরে-চক্ষু দিয়ে
কেননা তিনি অলৌকিক ভাবে স্যেন নদীর পারে নিজের মৃত্যুর কবিতা
পড়তে পেরেছিলেন
আমার আশা কোন বুনো বালক সন্ন্যাসী আমার কবরেও তার রচনা রাখবে
ঈশ্বর স্বর্গে শীতের রাত্রে আমাকে পড়ে শোনাবার জন্য
আমাদের হাত এতক্ষণে সে জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়েছে আমার হাত
এখন লিখেছে
প্যারিসের গী ল্য কুরের একটি ঘরে
আ উইলিয়ম তোমার মাথার মধ্যে কি জোর ছিল কার নাম মৃত্যু
আমি সমস্ত সমাধি ভূমির উপর দিয়ে হেঁটে গেছি এবং তোমার কবর
পাইনি
তোমার কবিতার মধ্যে ঐ অদ্ভুত ব্যান্ডেজ বলতে তুমি কি বুঝিয়েছিলে
হে পবিত্র পীড়াদায়ক মৃত্যু তোমার কি বলার আছে কিছু না এবং মোটেই
তা যথেষ্ট উত্তর নয়
তুমি ছফুট কবরখানায় মোটেই গাড়ি চালাতে পারো না যদিও এই
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিরাট স্মৃতিভাণ্ডার যেখানে সবই সম্ভব
বিশ্বজগৎ এক সমাধিভূমি এবং এখানে আমি একা হাঁটছি
পঞ্চাশ বছর আগে আপলিনেয়ার এই পথেই হেঁটেছেন জানি
তার পাগলামি কোণে কোণে আছে এবং জাঁ জেনে আমাদের সঙ্গে
বই চুরি করছে
পশ্চিম আবার যুদ্ধে মেতেছে এবং কার মধুর আত্মহত্যায়
এর মীমাংসা হবে
গীয়ম গীয়ম তোমার খ্যাতিকে আমি কত ঈর্ষা করি, মার্কিন সাহিত্যের
প্রতি তোমার অনুকম্পাকে
মৃত্যু সম্বন্ধে দীর্ঘ উন্মাদ ষাঁড়ের গোবর লাইন সমেত তোমার পরিধি
কবর থেকে বেরিয়ে এসো এবং আমার দরজা দিয়ে কথা বল
নতুন রূপকল্পের মালা বার করো সামুদ্রিক হাইকু, মস্কোর নীল ট্যাক্সি
বুদ্ধের নিগ্রো মূর্তি
তোমার পূর্ব অস্তিত্বের ফোনোগ্রাফ রেকর্ডে আমার জন্য প্রার্থনা করো
দীর্ঘ বিষাদময় গলায় এবং গভীর মিষ্টি সুরের মতো ধ্বনিতে, করুণ এবং
প্রথম মহাযুদ্ধের মতো কর্কশ
আমি খেয়েছি তোমার কবর থেকে পাঠানো নীল ক্যারোট এবং ভ্যান
গঘের কান
এবং পাগলাটে আরতোর ক্যাকটাস
এবং নিউ ইয়র্কের পথ দিয়ে হেঁটে যাবো ফরাসি কবিতার কালো
আঙরাখার মধ্যে
পের লাসেজে আমাদের কথাবার্তায় কিছু সংযোজন করে
এবং তোমার সমাধির উপরে যে আলোর রক্তপাত হচ্ছে আগামী কবিতা
তার থেকে প্রেরণা পাবে।
.
(২)
এখানে প্যারিসে আমি তোমার অতিথি হে বন্ধুপ্রতিম ছায়া
ম্যাক্স জেকবের অদৃশ্য হাত
যৌবনের পিকাসো আমাকে দিচ্ছে এক টিউব ভূমধ্যসাগর
নিজে রুসোর প্রাচীন লাল নিমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলুম আমি তার বেহালা
খেয়ে ফেলেছি
বাতো ল্যাভোয়ারের বিশাল পার্টিতে উপস্থিত ছিলাম আলজিরিয়ার
পাঠ্যপুস্তকে যা উল্লেখিত হয়নি
বোয়া দ্য বুলোনে জারা বুঝিয়েছে কোকিলের মেসিনগানের রসায়ন
আমাকে সুইডিস ভাষায় অনুবাদ করতে করতে সে কাঁদে
কালো প্যান্ট এবং বেগুনি টাইতে সুসজ্জিত
মিষ্টি রক্তিম দাড়ি তার মুখ থেকে বেরিয়ে আছে যেন নৈরাজ্যের
দেওয়াল থেকে ঝোলা শ্যাওলার মতো
আঁদ্রে ব্রেঁতোর সঙ্গে তার ঝগড়ার কথা সে বলেছিল অনর্গল
যাকে সে একদিন সাহায্য করেছিল সোনালি গোঁফ পাকিয়ে নিতে
বুড়ো ব্লেইজ সেঁদরার পড়ার ঘরে আমাকে অভ্যর্থনা করেছিল এবং
বিরক্তভাবে সাইবেরিয়ার বিশাল দৈর্ঘের কথা বলেছিল
জাক ভাসে তার পিস্তলের ভয়ংকর সংগ্রহ দেখাতে নিমন্ত্রণ করেছিল
আমাকে
বেচারা কক।।তো একদা চমৎকার রাদিগের জন্য বিষগ্ন ছিল এবং তার
শেষ ভাবনায় আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম
মৃত্যুর কাছে পরিচয় পত্র নিয়ে রিগো
এবং জীদ টেলিফোন এবং অন্যান্য অদ্ভুত আবিষ্কারের প্রশংসা করেছিল
আমরা প্রধান বিষয়ে একমত হয়েছিলাম যদিও সে সুগন্ধি আন্ডারপ্যান্ট
সম্বন্ধে বকবক করেছিল অনেক
কিন্তু তাহলেও সে হুইটমানের ঘাস গভীরভাবে পান করেছে এবং
কলোরাডো নামে সমস্ত প্রেমিকরা তাকে ঈর্ষা করেছে
আমেরিকার যুবকরা হাতভর্তি শার্পনেল এবং বেসবল নিয়ে হাজির
ওঃ গীয়ম, এ পৃথিবীর সঙ্গে যুদ্ধ করা কত সহজ, কত সহজ মনে হয়
তুমি কি জানতে বিরাট রাজনীতির উচ্চাঙ্গ লেখকরা মঁপারনাসে
ঢুকে পড়বে
তাদের কপাল সবুজ করার জন্য শুধু এক বসন্তের অবতারের লরেল নিয়ে
তাদের বালিশে একদানা সবুজ নেই, তাদের যুদ্ধ থেকে একটিও পাতা
নেই—মায়াভস্কি এসেছিল এবং বিদ্রোহ করেছিল।
.
৩.
ফিরে এসে একটা কবরের উপর বসে তোমার স্মৃতি ফলকের দিকে
তাকিয়ে আছি
অসমাপ্ত লিঙ্গের মতো এক খণ্ড পাতলা গ্রানাইট
পাথরে একটি ক্রুস মিলিয়ে যাচ্ছে, পাথরে দুটি কবিতা একটি ওল্টানো
হৃদয়
অপরটি প্রস্তুত হও আমার মতো যে অলৌকিক
উচ্চারণ করেছি আমি কসম্রোউইস্কির গীয়ম অ্যাপোলিনেয়ার
কে যেন ডেজি ফুণ ভর্তি একটা আচারের বোতল রেখে গেছে এবং একটি
৫ বা ১০ সেন্টের সুররিয়ালিস্ট ধরনের কাচের গোলাপ
ফুল এবং ওল্টানো হৃদয়ে সুখী ছোট্ট সমাধি
একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে যার সাপের মতো গুড়ির কাছে আমি বসেছি
গ্রীষ্মের বাহার এবং পাতাগুলো সমাধির উপরে ছাতা এবং কেউ
এখানে নেই
কোন্ অশুভকণ্ঠ কাঁদে গীয়ম কোথায় তুমি এলে
তার নিকটতম প্রতিবেশী একটি গাছ
সেখানে নীচে হাড়ের স্তূপ এবং হলুদ খুলি হয়তো
এবং ছাপানো কাব্য অ্যালকুলস্ আমার পকেটে, তার কণ্ঠস্বর
মিউজিয়মে
এবার একটি মধ্যবয়স্ক পায়ের ছাপ কবর ঘুরে যায়
একটা লোক নামের দিকে তাকায় এবং কবর গৃহের দিকে
চলে যায়
একই আকাশ মেঘের মধ্যে ঘোরে যুদ্ধের সময় রিভিয়েরাতে
ভূমধ্যসাগরের দিনগুলি যেমন ছিল
ভালোবাসায় অ্যাপোলো পান করে মাঝে মাঝে আফিম খেয়ে সে আলো
আলো নিয়ে গেছে
সেন্ট জারমেনে কেউ নিশ্চয়ই আঘাতটা বুঝেছিল যখন সে যায়,
জেকব এবং পিকাসো কেশেছিল অন্ধকারে
একটা ব্যান্ডেজ খোলা হলো এবং ছড়ানো বিছানায় একটা মাথার খুলি
স্থির হয়ে রইলো
থলথলে আঙুল, রহস্য এবং অহঙ্কার চলে গেল
দূরে রাস্তায় একটা ঘণ্টা বাজলো, পাখিরা কিচির মিচির করে উঠলো
চেস্টনাট গাছে
ফামিল ব্রেমোঁ কাছেই ঘুমিয়ে আছে, বিশাল বুক এবং যৌন আকর্ষণ করার
মতো যিশু ঝুলছে তাদের কবরে
আমার কোলের উপরে সিগারেট ধোঁয়া দিচ্ছে এবং পাতাগুলি ধোঁয়ায়
ভরিয়ে দিচ্ছে এবং আগুন জ্বলছে
একটা পিঁপড়ে আমার কঞ্জুরয়ের হাতায় দৌড়ে গেল এবং যে গাছে
আমি ভর দিয়ে আছি সেটা ক্রমশঃ বড় হচ্ছে
ঝোপ এবং গাছপালা কবর ছাড়িয়ে ওপরে উঠছে একটা সোনালি
মাকড়সা ঝঝ করছে গ্রানাইটে
এখানে আমার কবর হয়েছে এবং আমার কবরের পাশে একটি গাছের
নীচে বসে আছি।

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 120

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts