Poem

নিজের মাথার বালিশ

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তুমি দেশের জন্য প্রাণ দিও না, দেশ-টেশ সব বাজে কথা
দ্যাখো, অন্ধকারের জাদুকর কাচপোকার টিপ দিয়ে
মোহর বানাচ্ছে
পায়রাগুলো ইঁদুর হয়ে ঢুকে যাচ্ছে গর্তে
দ্যাখো, রক্তের নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা হাঁস, তার গায়ে
একটা ছিটেও লাগেনি

দ্যাখো, কালকের শেয়াল হঠাৎ আজ কী করে হয়ে গেল বেড়াল
ওদের কোনও দেশ নেই
নারীর গর্ভে যখন জ্বণ হয়ে ফুটেছিলে, তখন তোমারও কোনও
দেশ ছিল না

সার সার অন্ধ ফৌজ কুচকাওয়াজ করছে পাহাড় সীমান্তে
ওদের অস্ত্রগুলো কোনও দেশ চেনে না
মৃত্যুও কোনও দেশকে চেনে না
তুমি চোখ মেলেছিলে প্রকৃতির মধ্যে, প্রথম দেখেছিলে আকাশ
তুমি জীবনের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ, বাজে কাগজের ঝুড়িতে
ফেলে দিও না তোমার প্রাণ!

কত রকম রঙ গুলে লেখা হয়েছে দেশাত্মবোধক গান
সেই সব গানের উন্মাদনায় চাঙ্গা হয়েছে ছুরি বন্দুকের কারখানা
হাওয়ায় উড়ছে মৃত্যুব্যবসায়ীদের হাসির ফুলকি
যারা লালকেল্লার মাচায় দাঁড়ায়, যারা মনুমেন্টের নীচে
দেশের নামে গরম গরম থুতু ছেটায়
যারা ভবিষ্যতের চোখ ধাঁধানো স্বপ্ন দেখিয়ে তোমার প্রাণ বলি চায়
দ্যাখো, তারা কত যত্নে মুড়ে রাখে নিজেদের জীবন
তাদের সন্তান সন্ততিরা থাকে দুধে ভাতে, তোমার বংশধরেরা
হা-ঘরে হয় হোক

তুমি রেল লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে তোমারই মতন একজনকে
মারলে কিংবা নিজে মরলে
ওখানে কোনও দেশ নেই
তুমি এক মিছিলে থেকে আর একটা মিছিল ভাঙতে গিয়ে
ছিন্নভিন্ন শরীরে লুটিয়ে পড়লে মাটিতে
ওখানে কোনও দেশ নেই
যারা হাততালি দিয়ে তোমাকে বলছে, যাও, যাও, আগুনে ঝাঁপ দাও
তারা একটু পরেই চলে যাবে ফুলের বাগানে
তুমি প্রাণ দিও না, নিও না, দেশ-টেশ সব বাজে কথা
মৈত্রেয়ীর প্রগল্‌ভতার উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য কী বলেছিলেন মনে নেই?
সামান্য একটা দেশের জন্য তুমি পৃথিবীকে ছাড়বে কেন
নিজের বিছানার প্রিয় মাথার বালিশটার কথা মনে পড়ে না?

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 259

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts