Poem

নির্মাণ খেলা : দুই

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

রতিকৌতুকে দোলে চন্দ্রমা দোলে চন্দ্রমা দোলে
জলে ভেসে আছে খানিক আকাশ খানিক মেঘের ভেঁড়া অবকাশ
রাত্রিবসনা এ কেমন নারী দেবতাকে দেয় নীল তরবারি
বুক পেতে দেয় ঊরু ঝলসায় মায়া সিন্দুক খোলে…

এই চারলাইন লেখার পর আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। প্রায় মধ্যরাতে দোতলার জানলা থেকে পুকুরের জলে চাঁদের দোল খাওয়া দেখে কবিতার প্রথম লাইনটি মনে আসে। চাঁদের সঙ্গে পৃথিবীর যাবতীয় জলের যৌন সম্পর্ক। প্রথম লাইনটি সে জন্য স্বাভাবিক। দ্বিতীয় লাইনটিতে অনেক দ্বিধার কাটাকুটি আছে। প্রথমে লিখেছিলাম, ‘জলে ঢেউ ওঠে, জলে বিভঙ্গ আকাশের এক কণা…’। তেমন পছন্দ হলো না। ছন্দের চালটা বদলালে মন্দ কী? দ্বিতীয়বার লেখার পর ছেঁড়া অবকাশ নিয়ে একটু খটকা লেগেছিল, তারপর ভাবলাম, চলুক না!
তৃতীয় লাইনে নীল তরবারির বদলে প্রথমে লিখলাম মায়া তরবারি, এটা খুব সহজে প্রথাবাহিত ভাবে আসে। প্রথার ভূত মাথা থেকে তাড়ানো খুব শক্ত। কিন্তু চতুর্থ লাইনে মায়া শব্দটা আমার আবার দরকার। মায়া তরবারির চেয়ে মায়া সিন্দুক অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে, তখনই দেখতে পাই নীল তরবারি।
চাঁদ যখন দেবতা ছিল, তখন যৌন টানের নামই ছিল প্রেম। দেবতারা আসলে প্রেম জানে না। নীল আর্মস্ট্রং-এর পায়ের ধুলো পড়ার পর চাঁদ আর দেবতা নেই। তাছাড়া, এই চার লাইনের মধ্যে আমি কোথায়? কাটাকুটি করে লাইনগুলি এই ভাবে রূপান্তরিত হয় :
এত শব্দ কেন, দিগন্তে কেন আগুন?
বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে নেমে গড়িয়ে যায় রক্ত
কারা হঠাৎ হঠাৎ আমার কান ধরে টানে?
ঘাড় মুচড়ে পেছন দিকে ফিরিয়ে দেয় মুখ
মানব সভ্যতার মধ্যে কত শতাব্দীর আবর্জনা, এত নোংরা গন্ধ
মধ্যরাতে ঘর ছেড়ে, বাইরে চলে আসি
বুকে ভরে নিশ্বাস নিই, সেই বাতাসে মেশানো অশ্রু
নদীর জলে লুটোপুটি খাচ্ছে চাঁদ, এ যেন বিশ্ববিশ্রুত প্রেম
নিঃশব্দ নিশীথে দোলে হাওয়া।
ওরা কিছুই জানে না
বারান্দায় একা বসে সমস্ত শরীর ও শাস উষ্ণ হয়ে ওঠে
সাঙ্ঘাতিক ইচ্ছে করে নদীতে উন্মুক্ত হয়ে নেমে পড়তে
কিন্তু তাকে স্পর্শ করার আগে বারবার প্রশ্ন করি, আমাকে
ভালোবাসবে নদী?
[এতে ছন্দ নেই, এত গদ্যময় হয়ে গেল রাত। আর লিখতে ইচ্ছে করে না। কলম সরিয়ে রেখে বারবার মনে মনে আওড়াই : রতিকৌতুকে দোলে চন্দ্রমা দোলে চন্দ্রমা দোলে। রতি কৌতুকে দোলে চন্দ্রমা দোলে চন্দ্রমা…]

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 121

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts