Poem

স্মৃতির শহর ০৫

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

দীপেন বলে গেল, জলটুঙ্গিতে যাচ্ছি,
চলে আসিস!

তখন আমার সময় হয়নি
তখন আমি ঈষৎ ব্যস্ত ছিলুম যোষিৎ-চর্চায়
কফি হাউসের ধোঁয়া ও গুঞ্জরনের মধ্যে বসে থেকেও
নিরুদ্দেশে যাবার কোনো বাধা ছিল না
বাইরে দুচারটে বোমার শব্দ শুনলেও মনে হয়
ও কিছু নয়!
নদীর স্রোতের মতন মিছিল আসে ও যায়
আমিও এক মিছিল থেকে
ঘাটের পৈঠায় উঠে বসেছি
পায়ে এখনো লেগে রয়েছে ঝিনুক-ভাঙা রক্ত
শিরদাঁড়ায় শোঁয়াপোকার মতন ঘাম
এই সময় পোশাক বদলাবার মতন
চরিত্রটাও কিছুক্ষণের জন্য বদলে নিতে হয়!
কফি হাউসের সবচেয়ে রূপবান পরিচারকটি।
ডেকে তুললো আমায়
ঈষৎ হেসে বললো, আর কেউ নেই।
সময় চলে গেছে।
আমি কি তবে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম?
চোখ-মেলা শূন্যতায় শুধু চোখে পড়লো
আমায় ঘিরে রয়েছে পাতলা সবুজ বাতাবরণ
এবং এক চতুষ্কোণ অন্ধকার সীমারেখা
সমস্ত চেয়ার ও টেবিলগুলি নগ্ন
শত শত বিশ্বাস ও কলস্বর বিবর্জিত
এই স্থানে আমি আগে কখনো আসিনি
যেন আমাকে নির্বাসন দিয়ে সবাই
আত্মগোপন করেছে
আমার পকেটে একটি পয়সা নেই
সিগারেট-দেশলাই নেই
কোনও ঠিকানা লেখা কাগজ নেই
বুক পকেটের অতি পরিচিত কলমটি নেই
এমনকি কপাল থেকে হিজিবিজি মুছে ফেলবার জন্য
রুমালটি পর্যন্ত নেই
সিড়ি দিয়ে নেমে আসে পা-জামা ও পাঞ্জাবি পরা
আমার একুশ বছরের শরীর
দরজার কাছে সেই চেনা মুখটিও নেই
দোকান বন্ধ করে ইসমাইল চলে গেছে কোথাও
ধোঁয়ার মুখশুদ্ধি এখন কেউ ধারও দেবে না
আমার হাতে ঘড়ি নেই
আকাশে চন্দ্রনক্ষত্র নেই
পথের বাতিগুলো নেভাননা
যেন এক খণ্ডযুদ্ধের পর কবরখানায় নিস্তব্ধতা।

এই রকম সময়ে নিঃস্বতাও এক রকম অহংকার
এনে দেয়
যেন এই জনশূন্য কলেজ স্ট্রিটের আমিই রাজা
আমি এখন হাততালি দিয়ে বলতে পারি,
কোই হ্যায়?
আমার নির্দেশে এখানে শুরু হতে পারে বহ্যূৎসব
ঝাঁপফেলা দোকানগুলোর ভেতর থেকে
মৃত গ্রন্থকারেরা কৌতূহল মেশানো ভয়ে
উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছেন আমাকে
ছাপা অক্ষর ও শব্দের এই জগৎটিকে একটুখানি
ঝাঁকিয়ে দেবার জন্য
আমি ডান হাত উঁচু করতেই
আমার সামনে এসে দাঁড়ায় একটি পুলিশের গাড়ি
আমি প্রেতাত্মার মতন হেসে উঠি
তারা আমাকে প্রকৃত প্রেতাত্মাই মনে করে হয়তো
তাদেরই হাতে নিহত কোনো শব থেকে
যে উঠে এসেছে
বস্তুত আমারই সম্মানে যে ঘোষিত হয়েছে সান্ধ্য আইন
তা তারাই জানিয়ে দেয়
পুলিশের পোশাক পরা চারখানা মানুষের
বুক থেকে শব্দ ওঠে হাপরের মতন
তারা প্রত্যেকেই কারুর পিতা কিংবা ভাই কিংবা পুত্র
এই নির্জনতায় হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেই কথা
অতি দ্রুত বাড়ি ফিরে যাবার জন্য তারা ব্যস্ত
তাদের গাড়ির ইঞ্জিনে অবিকল কান্নার শব্দ।

গোলদিঘির রেলিং-এ কিছুকাল ভর দিয়ে
দাঁড়িয়ে থাকার পর
স্মৃতিতে কয়েকটি স্ফুলিঙ্গ ফিরে আসে
দীপেন বলেছিল
জলটুঙ্গিতে দেখা হবে।
কোথায় সেই জলটুঙ্গি, কত দূরে?
ভালোবাসার মন প্রচ্ছন্ন এক জলাভূমি
রয়েছে এই শহরের হৃৎপিণ্ডে
তার মাঝখানে কাঠের টঙের মাথায় ছোট কুঠুরি
সেখানে বন্ধুরা বসে আছে গোপন বৈঠকে
সিগারেটের ধোঁয়ায় কারুর মুখ দেখা যায় না
সেখানে সাবলীল চা আসে কবিতার লাইনের মতন
পারস্পরিক উষ্ণতায় কেটে যায় শীত
আমার বুক মুচড়ে উঠলো।
এক যৌবনব্যাপী উত্তেজনা
আমায় যেতে হবে, যেতে হবে
আমি রাস্তা চিনি না, আমায় যেতে হবে
আমার অন্য আস্তানা নেই,
পৃথিবীতে আর কোনো আত্মীয় নেই
আমায় সেই জলটুঙ্গিতে যেতে হবে!

Author Bio

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ২৩ অক্টোবর ২০১২) বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে

More

This post views is 127

Post Topics

Total Posts

1193 Published Posts